বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মোট ৩৭ জন এমপি মন্ত্রী গ্রেফতার হয়ে দেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন। এদের মধ্যে ৯ জনকে কারাগারে ডিভিশন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর বকশিবাজারে অবস্থিত কারা অধিদপ্তরে কারা নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন গৃহীত ব্যবস্থাদি সম্পর্কিত ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন কারা মহাপরিদর্শক
(আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কারাগারে হওয়া হামলার ঘটনায় মোট ২৮২ জন কারারক্ষী ও কারাকর্মকর্তা আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছিলেন তারা বিভিন্ন হাসপাতালে পরবর্তীতে চিকিৎসা নেন। এছাড়া এখনো কিছু কারারক্ষী ও কারাকর্মকর্তা চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যেসব বন্দিরা সাজাভোগ করেছেন তারা রেয়াত পেতে পেতে মুক্তি পেতে পারেন। যখন তারা মুক্তির আওতায় চলে আসেন তখন তারা মুক্তি পেতে পারেন। যারা মুক্তির আওতায় চলে আসেন তাদের বিষয়ে প্রস্তাবনা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাঠাই। পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেটিং এর পর চূড়ান্তভাবে যদি মাফ করতে হয় সেটা রাষ্ট্রপতি করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে মাফ করার অধিকার রাষ্টপতির তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রধান উপদেষ্টাও পারেন। এরকম অনেক বন্দিদের বিষয়ে প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয় পাঠানো আছে। এই বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করছি। এই বিষয়ে অতি শীঘ্রই একটি বৈঠকের প্রস্তাবনা আছে। যারা অক্ষম চলাফেরা করতে পারে না অথবা যারা রেয়াত পাওয়ার যোগ্য তাদের মুক্তি দেওয়া হতে পারে।
পলাতক বন্দিদের মধ্যে জঙ্গি কতজন রয়েছে এবং তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত নয়জন জঙ্গি পালিয়েছে। এছাড়া বিচারাধীন মামলার অনেক জঙ্গি পালিয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৭০ জন জঙ্গি পলাতক রয়েছে।
মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক বন্দিদের গ্রেফতারের বিষয়ে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি, মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি ও যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামি পালিয়ে ছিল মোট ৯৮ জন। এদের মধ্যে অনেককে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের সকল কারাগারের ধারণক্ষমতা কত ও বর্তমানে কত জন বন্দি রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের সকল কারাগারের ধারণক্ষমতা ৪২ হাজারেরও কিছু বেশি। এই মুহূর্তে আমাদের কারাগারে আছে ৫০ হাজারেরও বেশি বন্দি।
কারাগারে হামলার সময় কত আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক বলেন,কারাগার থেকে ৯৪ টি অস্ত্র লুট হয়ে গিয়েছিল। এখনো উদ্ধার করা বাকি আছে ২৯ টি অস্ত্র। অস্ত্র উদ্ধারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মোট সংখ্যা ৬৫ টি।
কারাগারে নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রমের সাথে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা নিয়ম-বহির্ভূত কার্যক্রমের সাথে জড়িত তাদের কয়েকজনকে আমরা চিহ্নিত করেছি।
তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলমান রয়েছে। একটা সাধারণ ধারণা কারাগার এবং কারা কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত। আমি কারা মহাপরিদর্শক হিসেবে এটা স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি যদি অস্বীকার করি তাহলে এটাকে আমি কাভার করব।
আমি স্বীকার করে নিচ্ছি তার মানে হল আমি এটা কি তা খুঁজে বের করব। যেসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোটা দাগে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে আমি অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা নিচ্ছি।
এ বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা শিগ্রই দেখা যাবে।
দুর্নীতি প্রতিরোধে সৎ অফিসারদের আমরা পদায়ন করছি। লম্বা সময় ধরে কিছু লোক একই জায়গায় কাজ করছিল তাদের সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
৫ আগস্ট এর পর এখন পর্যন্ত কারাগার থেকে সাধারণ মানুষসহ কতজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বের হয়ে এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরকম আলোচিত মোট ৪৩ জন বন্দি এখন পর্যন্ত কারাগার থেকে জামিন পেয়ে মুক্ত হয়েছেন। শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শীর্ষ জঙ্গি এসব মামলায় যারা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর কিছু কিছু কারাগারে হামলা হয় এ সময় সাধারণ মানুষদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায় এরা আসলে কারা ছিল কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চিহ্নিত করেছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের সনাক্ত করার জন্য আমরা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিচ্ছি। ৫ আগস্ট এর পরে যারা হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে অনেক সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতেও হামলা হয়েছিল। কারাগার যেহেতু একটি ক্ষোভের জায়গা ছিল এরই বহিঃপ্রকাশ এসব হামলা।
কারাগারের হামলার ঘটনায় কতগুলো মামলা করা হয়েছে এবং এসব মামলায় তাদেরকে আসামি করা হয়েছে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, যেসব কারাগারে বিশৃঙ্খলা হয়েছিল আমরা প্রতিটাতেই মামলা করেছি। মামলায় আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে আসামি করতে পারিনি কারণ পরিস্থিতি যেহেতু ভিন্ন ছিল। অজ্ঞাতনামা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে মূলত মামলা করা হয়েছে। আটটি কারাগারে বিশৃঙ্খলার দায়ে মোট ৮ টি মামলা দায়ের হয়েছে। আমাদের পাঁচটি কারাগার থেকে বন্দিরা পালিয়েছে শেষ সংক্রান্ত ৫ টি মামলা হয়েছে। তবে সবমিলে আমাদের ১৭ টি কারাগারে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।
কারাগারের কর্মর্তদের ডোপ টেস্টের বিষয়ে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যোগদান করার পর মাদকের বিষয়ে ব্যাপক অভিযোগ পাচ্ছি। আসলে এই বিষয়ে আমরা শংকিত। মাদক সংক্রান্ত অভিযোগ বন্দিদের বিষয়ে যেমন পাচ্ছি তেমনি কারারক্ষী এবং কারা কর্মকর্তাদের বিষয়েও পাচ্ছে। এই বিষয়ে আমাদের সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গাটি হল যে এটিকে আমরা খুজে কিভাবে বের করব। তবে এ বিষয়ে আমরা কিছু কার্যক্রম করছি। কারাগারে যেন মাদক না ঢুকতে পারে সেই বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। মাদকাসক্ত কেউ কারা বিভাগে চাকরিরত অবস্থায় থাকতে পারবে না।
কারাগারে নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ বিষয়ে আমরাও আমাদের মত করে তদন্ত করছি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
গত ১৫ বছরে যে পরিমাণ কাস্টডিয়াল মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আসলে আইনের একটা বিষয়। রুটিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যদি কোন জায়গায় সন্দেহ হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। আর কেউ যদি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাহলে তাদেরকে আমরা অবশ্যই সহযোগিতা করব।
জুলাই ও আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যারা গ্রেফতার হয়েছিল তাদের মধ্যে কতজন বন্দি এখনো কারাগারে আছে আর কতজন জামিন পেয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্দোলন চলার সময় যেই ধরনের মামলা হয়েছিল এবং গ্রেফতার হয়েছিল এ ধরনের বন্দি এখন আমাদের কাছে নেই। সবাই জামিন প্রাপ্ত হয়ে গেছেন এবং জামিনে বের হয়েছেন। আন্দোলনের কতজন বন্দি জামিনে বের হয়ে গিয়েছে তার সঠিক সংখ্যাটা বলা মুশকিল। তবে সেই সময় আমাদের বন্দি সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার, এখন তা ৫৫ হাজার। তাহলে বলা যায় ওই সময় এসব মামলায় গ্রেফতার প্রায় ১৫ হাজার বন্দি ধীরে ধীরে জামিন পেয়ে বের হয়েছেন।
বিদেশি বন্দিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাজা ভোগ হওয়ার পরও তাদের অনেকে জেলে থেকে যায়। এখন পর্যন্ত কতজন বিদেশি বন্দি আছে এবং তাদের বিষয়ে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশি বন্দিদের সাজা শেষ হয়ে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পরে আমরা তাদেরকে ডি-পোর্ট করি। এখন আমাদের কারাগারে মোট ১৪৩ জন বিদেশি বন্দি রয়েছেন। আমরা যদি ক্লিয়ারেন্স পায় তাহলে আমরা তাদেরকে নিজ নিজ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।
গত ৫ আগস্ট এর পরে যেসব মন্ত্রীরা এবং এমপিরা গ্রেফতার হয়েছিলেন তারা কারাগারে কোন ডিভিশন পাচ্ছে কিনা প্রশ্ন করা হলে আইজি প্রজন্স বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সরকারি গেজেটেড অফিসাররা কারাগারে আসতে ডিভিশন পেয়ে যান।
বাকি যারা বিশিষ্ট ব্যক্তি বা এমপি মন্ত্রী আছেন তারা আবেদন করবেন অথবা এ বিষয়ে আদালত বললে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আর যাদের বিষয়ে আদালত বলবেনা তারা যদি আবেদন করেন তখন সে আবেদনটি আমরা ডিসির কাছে পাঠাবো, ডিসি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা তাদেরকে ডিভিশন দিতে পারব। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে বিশেষ বন্দি (এমপি-মন্ত্রী) মোট ৩৭ জন তাদের মধ্যে ৯ জন ডিভিশন পাচ্ছেন আর বাকিদের বিষয়টা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ওপরে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারাগারে কোন বিদ্রোহ ছিল না বিশৃঙ্খলা ছিল। কিছু দাবি দাওয়া ছিল সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে।
ডিআই/এসকে