এম এন আলী নাইম:
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সেকেন্ড সিটি রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিআরডিপি-২) প্রকল্প পরিচালক এলজিইডি প্রধান কার্যালয় আগারগাও ঢাকায় কর্মরত মো.হামিদুল হক এর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রীয় যেসব বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয় তার অন্যতম হচ্ছে দুর্নীতি। বলা হয়ে থাকে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশে বিপুল উন্নয়ন কর্মকান্ড চলতে থাকলেও এসব উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকৃত সুফল ভোগ করেছে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী,এমপি,অংগ সংগঠন, পরিবারের সদস্য ও তাদের সহযোগী দোসরেরা। জনগণ বঞ্চিত হয়েছে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চলতে থাকা সীমাহীন দুর্নীতির কারণে। এখন অনুসন্ধান ও তদন্তে জানা যাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরের রাঘববোয়ালদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে। পতিত সরকারের আমলে বিভিন্ন দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহযোগী দোসর কর্মকর্তারা অবৈধ সম্পদের পাহাড় বানিয়া ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এলজিইডি দেশের সর্ববৃহৎ প্রকৌশল সংস্থা। এখানে প্রায় ১৩ হাজার ৩৯৪ জনকর্মচারী কর্মরত। তাদেরই একজন নির্বাহী প্রকৌশলী হামিদুল হক। বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) এক অনুসন্ধানে জানা যায়।
সারা দেশে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সেকেন্ড সিটি রিজিয়ন প্রকল্পে বিশাল অংকের দুর্নীতি করে টাকার মেশিন ঘুরিয়েছেন শত কিলোমিটার গতিতে। তিনি পতিত সরকারের একজন সক্রিয় দোসর ছিলেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়ীত ছিলেন এবং যার সুবাদে এলজিইডি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের অন্যতম সদস্য বনে যান। খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি এখনো স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত আওয়ামীপন্থি অফিসারদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রেখে চলেছেন এবং কাজের গতি কমিয়ে সরকারকে চাপে ফেলবার নানা রকমের চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। অথচ প্রশ্ন করা হলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সকল সুবিধা নেওয়া মো.হামিদুল হক এখন ভোল্ট পাল্টিয়ে নিজেকে বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে পরিচয় দিচ্ছে বলে সূত্র প্রকাশ রয়েছে। তিনি জীবনেও কোন দিন আওয়ামী লীগ করেননি বলে দাবি করছে এবং নিজেকে বঞ্চিত বলেও জানান দিচ্ছেন। আর যে অবৈধ সম্পদ করেছে তা তিনি অস্বীকার করে আসছে দাবি করেছেন,শুধু মোহাম্মদপুর নবদয় হাউজিং এ তার শশুড় প্রদত্ত একটি বাড়ি আছে, বাকি সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিআরডিপিতে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নেয়ার পর বেপরোয়া হয়ে যান মোঃ হামিদুল হক। তার টাকা তৈরির মেশিন ছিলেন স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলামের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো.জাহিদ হোসেন চৌধুরী। জাহিদের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে সম্পদের পাহাড় গড়েন হামিদ। সকল এলজিইডি প্রকল্প পরিচালক প্রধান প্রকৌশলীর মাধ্যমে মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করলেও,এপিএস জাহিদের মাধ্যমে মন্ত্রীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করতেন হামিদ। এই সুসম্পর্কে কাজে লাগিয়ে কন্সালটেন্সি ফার্ম রির্সোস প্লানিং এন্ড ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (আরপিএমসি) এর একজন ব্যবসায়িক অংশীদর হয়েছেন। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে এলজিইডির সমস্ত বড় বড় কন্সালটেন্সি প্যাকেজ আরপিএমসিকে পাইয়ে দিয়েছেন এবং আগামী প্রকল্পগুলোতেও সাহায্য করবেন শোনা যায়।
আরপিএমসিকে কাজ দিতে প্যাকেজের শর্তাদি নিজেদের সুবিধামত সাজানো,মূল্যায়ন কমিটিতে পছন্দসই লোক রাখা,যোগ্য ফার্মকে প্রাথমিক নির্বাচন হতে বাদ দেওয়া, আগে থেকে বাজেট
জানানো,জমা হবার পর আর্থিক প্রস্তাব পরিবর্তন, হুমকি দিয়ে প্রতিদ্বন্ধী ফার্মকে অংশগ্রহণ হতে বিরত রাখাসহ তার বিরুদ্ধে অজস্র অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাহিদের ও প্রধান প্রকৌশলীর সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং জেলায় নির্বাহী প্রকৌশলী পদায়নে,বদলী এবং বিভিন্ন প্রকল্পে ফার্ম ঠিকাদার নিয়োগে ছিল বিশাল বাণিজ্য।
অভিযোগ রয়েছে,প্রকল্পের ফাম নিয়োগে ১০%,ঠিকাদারী টেন্ডার অনুমোদনে ৫%,রিভাইস এবং ভেরিয়েশনের ৫০% এবং বিলের ৩% কমিশন নিতেন মো.হামিদুল হক। এছাড়াও তিনি প্রশিক্ষণসহ ভুয়া ভাউচার বিভিন্ন রকম ভাতা ভাউচারের মাধ্যমে অবৈধভাবে উত্তোলন করেন। এর আগে তিনি উপ-প্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান,এই প্রকল্প থেকে অনিয়ম-দুর্নীতি করে সাবেক মন্ত্রী মো.তাজুল ইসলামের যতো টাকা আয় করেছেন তার চেয়ে বেশি আয় করেছে হামিদ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন,অধিকাংশ টাকা হামিদের হাত দিয়ে এসেছে।
বিভিন্ন প্রকল্পে যেকোন নিয়োগে সাবেক মন্ত্রী মো.তাজুল
ইসলামের বা (এপিএস) মো.জাহিদ হোসেন এসব নিয়ে কথা বলতেন না। দেন-দরবার-দালালি সব করতেন হামিদ। কার সাথে কতো চুক্তি এসব অনেকটাই অন্ধকারে রাখা হতো। এর মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব সম্পদের অধিকাংশই স্ত্রী,ছেলে- মেয়ে ও তার নিকট বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের নামে গড়েছেন। দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দেশের বাহিরে পাচার করছে এমন অভিযোগে অনুসন্ধান করে জানা যায়, তার পরিবারের একাধিক সদস্য বিদেশে অবস্থান করছে উন্নত দেশে। সেখানে তিনি নিজের সেকেন্ড হোম তৈরি করেছেন। জানা যায় বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে তার একাধিক প্লট,বারিধারায় ফ্লাট,একধিক ব্যাংক এ্যাকাউন্টে অগনিত অর্থ,মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং এ সাততলা বিল্ডিং রয়েছে যার সমস্ত ফিটিংশ ও টাইলস দেশের বাহির হতে আনা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তার প্রকল্পের সমস্ত নিয়োগ ও সিদ্ধান্ত তার স্বেচ্ছাচারিতায় হয়ে থাকে,মন্ত্রীর আর্শীবাদে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না। নিজেকে নিয়মের উর্দ্ধে মনে করতেন এবং নিজ চাকরীক্ষেত্রের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য ও দুব্যবহার করতেন নিয়মিত। মন্ত্রীর সাথে সখ্যতার কারণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিরাও তাকে সমীহ করে চলতেন বলে জানা যায়।
শুধু তাই নয়,গণভবন কেন্দ্রিক তার ছিলো অবাধ বিচরণ। শেখ হাসিনা পালানোর আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে হামিদ সিন্ডিকেট হাসিনার নিজস্ব তহবিলে কোটি কোটি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মোঃ হামিদুল হক মিডিয়ার কাছে সমস্ত অভিযোগ এবং নির্দিষ্ট কোন দল ও ব্যাক্তিবর্গের সাথে সংশ্লষ্টতা অস্বীকার করেন। তার চাকরি জীবনে সীমাহীন দুর্নীতি,ক্ষমতার অপব্যবহার,অন্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা সত্বেও শুধুমাত্র আওয়ামী দলীয় ক্যাডার হওয়ার কারণে তাকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক পদে পদায়ন করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শত শত ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে,স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) এই দুর্নীতিবাজ প্রকল্প পরিচালকের রাহুগ্রাস হতে এখনও মুক্ত হতে পারেনি। মো.হামিদুল হক,নির্বাহী প্রকৌশলী এবং সেকেন্ড সিটি রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিআরডিপি-২) প্রকল্প পরিচালক পদে এলজিইডি প্রধান কার্যালয় আগারগাও ঢাকায় কর্মরত আছেন। তার পিতার নাম-মোঃ আব্দুস ছাত্তার,মাতার নাম-হামিদা খাতুন,স্ত্রীর নাম-আরমানা ইসলাম, তার জাতীয় পরিচয়পত্র নং-৭৭৯৩০০৩৪৬৩, জন্ম তারিখ-২৩/০৭/১৯৬৯ইং, স্থায়ী ঠিকানা- গ্রাম: ঘোষপাড়া, ডাকঘর+থানা-ঠাকুরগাঁও সদর, জেলা-ঠাকুরগাঁও। বর্তমান ঠিকানা- বাসা-২১০/বি, রোড-০৪, মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, মোহাম্মদপুর, উপজেলা-আদাবর, ঢাকা-১২০৭। তার টিন নং- ৮৩৯৭৯৭২৮৪৮৪০, কর সার্কেল-৭৫, কর অঞ্চল-০৪, ঢাকা। তার স্ত্রীর নাম-আরমানা ইসলাম, তার ঠিকানা-বাসা নং-১০/৩, রোড-০৩, প্যারামাউন হাউজিং, মোহাম্মদপুর, আদারব ঢাকা-১২০৭। তার স্ত্রীর টিন নং-৮৬৬২৯৮৮৪৮১৬৮, কর সার্কেল- ২০৩, কর অঞ্চল-১০, ঢাকা।
হামিদুল হক দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন বিশাল সম্পত্তির পাহাড়। দুদকে অভিযোগ সূত্রে জানা যায় ২১০/বি, রোড-০৪,মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি,মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। উক্ত বাড়িটি ৬ষ্ঠ তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়িটির সম্পূর্ণ বাড়ির মালিক হামিদুল হক নিজেই উক্ত বাড়িটি নিমার্ণ করতে ব্যয় দেখিয়েছেন বাড়িটির মূল্য তিনি ১,২০,৪৬, ৬১০ টাকা দেখিয়েছেন। স্বর্ণ দেখিয়েছেন ৩৮ভরি তার ২০২১ সালের ইনকাম টেক্স অনুযায়ি তিনি মোট তথ্য মতে ১৪৭.১২.৮৬০ কোটি টাকা দেখিয়েছেন। তার স্ত্রী আরমানা ইসলাম বাংলাদেশ মেডিকেল স্টাডিজ এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর কনসালটেন্ট হিসাবে কর্মরত আছেন। তার স্ত্রীর নামে ১১/১৬.সলিমুল্লাহ রোড মোহাম্মদপুর ঢাকা তিন তলা বাড়ি রয়েছে। তার স্ত্রী আরমানা ইসলাম এর ২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণী সূত্রে জানা যায় যে তিনি ১০৬.৮৬.৬৩৮ টাকা প্রদর্শন করেছেন। এছাড়াও তাদের দেশে ও বিদেশে অনেক অবৈধ সম্পদ রয়েছে। তার ও তার পরিবারের বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা রয়েছে এবং নামে বেনামে কোটি কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। হামিদুল হক এলজিইডি কার্যালয়ের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মাস্টারমাইন্ড, অবৈধ কর্মকান্ড করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে। তিনি মূলত আওয়ামীলীগ সরকারের দোষর এবং এখনে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে সরকারকে বিপদে ফেলার চেষ্টা চলমান রয়েছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে অর্থ সহযোগীতা দিচ্ছেন। তার বিষয়টি গুরুতর ভাবে তদন্ত করা জরুরি। এলজিইডির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল।