আজ ২ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার। পঞ্জিকার পরম্পরায় ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারিও ছিল বৃহস্পতিবার। এ দিন শেখ মুজিব সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন সর্বহারা পার্টির নেতা বিপ্লবী সিরাজ সিকদার। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হেফাজতে প্রথম আলোচিত হত্যাকাণ্ড। সরকারের শীর্ষপর্যায়ের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে তিনি পরিকল্পিত ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। সিরাজ সিকদারের এই হত্যাকাণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে সর্বাধিক আলোচিত। সময় গণনায় ওই আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ৫০তম বার্ষিকী আজ।ওই সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, একাধিক লেখকের বই ও সিরাজ সিকদারের অনুসারীদের বয়ান থেকে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার একদিন আগে সিরাজ সিকদার ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হন। পরে ওই দিনই তাকে বিমানে করে ঢাকায় আনা হয় এবং রাতে তাকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাজির করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। সেখানে নির্যাতনের পর ২ জানুয়ারি সকালে সিরাজ সিকদারকে নিয়ে যাওয়া হয় সাভার রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে সিরাজ সিকদারকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নিয়ে হাত বাঁধা অবস্থায় তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সংঘটিত প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ারের ওই ঘটনার বিবরণ পুলিশের প্রেসনোটের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সরকারি প্রেস নোটে দাবি করা হয়, সিরাজ সিকদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পার্টি-কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে নিয়ে যেতে রাজি হন। সে অনুযায়ী ২ জানুয়ারি রাতে একটি পুলিশ ভ্যানে তাকে ওইসব আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাভারের তালবাগ এলাকায় ভ্যান থেকে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভার থানায় একটি মামলা করা হয়।
অন্যদিকে, সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জুন সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন। রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন মহাপরিচালক নুরুজ্জামান, সাবেক মন্ত্রী মরহুম আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদসহ অনেকজনকে আসামি করে মামলার আর্জিতে বলা হয় আসামিরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধীনস্থ কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন। আসামিরা তৎকালীন সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সিরাজ সিকদার হত্যার নীলনকশা করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন।
আর্জিতে ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় সিরাজ সিকদারকে গণভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে নেওয়া হয়। শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সবাই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে সিরাজ সিকদারকে শেরেবাংলা নগর রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। এর পর তার ওপর আরও নির্যাতন চালানো হয়। ওই দিন (২ জানুয়ারি) রাত ১১টায় রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১ নম্বর আসামির সঙ্গে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যরা পূর্বপরিকল্পনা মতো বন্দি অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠায়।
এক্ষেত্রে পুলিশের প্রেসনোট এবং সিএমএম আদালতে করা মামলায় সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে দুই রকম তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ দুটি তথ্যের বাইরেও সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তার কখন, কোথায়, কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়- সে সম্পর্কে একাধিক তথ্য রয়েছে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ গ্রন্থে লিখেছেন, সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা (টেকনাফ) থেকে পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হন। সিরাজের ছোট বোন ভাস্কর শামীম শিকদার তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবকে দায়ী করেছিলেন।
সিরাজ সিকদারের ছোট বোন শামীম সিকদারের স্বামী জাকারিয়া চৌধুরীর মতে, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় ঢাকার রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
বাংলা পিডিয়াসহ অন্য একাধিক সূত্র মতে, রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে সাভার অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে।
আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে তিন সপ্তাহের মাথায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কালো শাসন বাকশাল ব্যবস্থা চালুর দিন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেষ ভাষণের দিন শেখ মুজিবুর রহমান সিরাজ সিকদারকে নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি দম্ভের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সেই সিরাজ সিকদার। আমরা জানি সে আজ কোথায়।’ এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমান বিনাবিচারে সিরাজ সিকদারের হত্যাকে কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করেছিলেন।
মুজিব সরকারের আমলে ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদারকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা এবং তাকে নিয়ে সরকার প্রধানের ওই উক্তি দেশের রাজনীতিতে নানা সমালোচনা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সাংবাদিকরা তাদের লেখায় সিরাজ সিকদার হত্যাকাণ্ডকে শেখ মুজিবুর রহমানের একটি অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে অভিহিত করেন। প্রয়াত বুদ্ধিজীবী ড. আহমদ শরীফ বিপ্লবী বীর সিরাজ সিকদার প্রসঙ্গে শিরোনামে এক লেখায় বলেন, সিরাজ সিকদার আজ আর কোনো ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়ের নাম। এ মানবতাবাদী সাম্যবাদী নেতাকে হাতে পেয়ে যেদিন প্রচণ্ড প্রতাপ শঙ্কিত সরকার বিনা বিচারে খুন করল, সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত আমরা তার জন্য প্রকাশ্যে আহা শব্দটি উচ্চারণ করতেও সাহস পাইনি। সেই গ্লানিবোধ এখনও কাঁটার মতো বুকে বিঁধে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে সিরাজ সিকদারের হত্যা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ আমার দেশকে বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সিরাজ সিকদারের হত্যাকাণ্ডটি বিচারবহির্ভূত। তবে, এটা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ার নয়। বলতে পারেন প্রথম আলোচিত ক্রসফায়ার। কারণ ৭২-৭৪ সময়কালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে রক্ষীবাহিনীর হাতে অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সিরাজ সিকদার যেহেতু আলোচিত ছিলেন যার কারণে ওই বিষয়টি বেশি আলোচিত ও প্রচারিত হয়েছে। আমরা যদি ওটাকে প্রথম ক্রসফায়ার বলি তাহলে রক্ষীবাহিনী এর আগে তিন বছর যেসব হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেটাকে ক্লিনশিট দেওয়া হবে।
সিরাজ সিকদারকে নিয়ে শেখ মুজিবের সংসদে দেওয়া বক্তব্যও ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে চান গবেষক মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, ওই বক্তব্য তিনি ‘দুর্নীতি ও অনিয়মে’ নিমজ্জিত তার সরকার ও দলের নেতাদের সতর্ক করার জন্য দিয়েছিলেন।
কে ছিলেন সিরাজ সিকদার
মেধাবী আর বুদ্ধিদীপ্ত সিরাজ সিকদার খুবই তরুণ বয়সে একটি শোষণ ও বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৭০ সালেই তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গঠন করেন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি। বরিশালের বর্তমান ঝালকাঠির পেয়ারা বাগানে ঘাঁটি গঠন করে সেটিকে মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করেন। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে সিরাজ সিকদার একই সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাকিস্তান আর্মি, ভারতীয় আর্মি এবং মুজিব বাহিনীসহ আওয়ামী লীগের সব সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাংলাদেশকে ভারতের কলোনি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে ভারতপন্থি গণবিরোধী শক্তি হিসেবে অভিহিত করেন। শুরু করেন শেখ মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নতুন গেরিলাযুদ্ধ। বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আকস্মিক হামলা শুরু করে তার বাহিনী। একজন তরুণ বিপ্লবীকে শেখ মুজিবুর রহমান বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে ভয় পান এবং ঠান্ডা মাথায় নাটক সাজিয়ে হত্যার পথ বেছে নেন।
১৯৪৪ সালের আজকের শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন সিরাজ সিকদার। তিনি ছাত্রজীবনে উদ্বুদ্ধ হন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ আদর্শে। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন, বিএম কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে আইএসসি পাসের পর তিনি ভর্তি হন আজকের বুয়েটে। ১৯৬৭ সালে বুয়েট থেকে পাস করার পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। অল্প কিছুদিন পরই তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং শুরু করেন সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি।