সৈয়দ মিজানুর রহমান
বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশের ব্যাংক-আর্থিক খাতের উন্নয়নকে ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক উন্নয়ন আখ্যা দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, হাসিনা সরকার দেশকে দুর্নীতির একটি উৎসকেন্দ্রে রূপ দিয়ে গেছে। ওই সময়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়েছে। বিষয়টির আরও স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বিগত পনের বছরে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যন্ত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের গ্রামের বাড়ি দেখলেই বুঝা যাবে তার সম্পদ কত। তাদের উত্থানই বলে একেবারে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত অর্থ লুটপাটের ভয়াবহতা। এটাকে তিনি আর সরকারের টপ টু বটম দুর্নীতিই হচ্ছে হাসিনার আর্থিক খাতের বড় সফলতা।
দৈনিক আমার দেশ’র সঙ্গে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ, আর্থিক খাতকে ঘুরে দাঁড় করানোর কৌশল, দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আগ্রহ এবং আগামী বাজেট নিয়েও কথা বলেন। আপনি দায়িত্ব নিয়ে আর্থিক খাতের কী চিত্র দেখতে পেলেন? প্রশ্ন করা হয়েছিল অর্থ উপদেষ্টার কাছে। সরল জবাবে তিনি বলেন, অর্থনীতি একটি দেশ একটি জাতি তথা একটি অঞ্চলের প্রাণ। আমি বলছি না সবই ধ্বংস হয়ে গেছে, আবার এটিও বলছি না সব ঠিক ছিল। কিন্তু পরিষ্কারভাবে এটা বলতে পারি বিগত পনের বছরে আর্থিক খাতের উন্নয়ন বলতে দুর্নীতির ছড়াছড়ি হয়েছে। ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার গতি হারিয়েছিল। সঠিক জায়গায় কিছুই ছিল না। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখছি ঋণের বিশাল একটি বোঝা। আন্তর্জাতিক বাজারের তেল বিক্রেতা টাকা পাবে, বিদ্যুৎ বিক্রেতা টাকা পাবে, ঋণদাতা টাকা পাবে। সবই পাওনাদার। তাদের একটি বড় চাপ আমরা সামাল দিচ্ছি। পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি শিগগিরই আর্থিক খাতের অরাজকতা নিয়ন্ত্রণে আসবে।
দ্রব্যমূল্য তথা মূল্য স্ফীতির উস্ফলন নিয়ে কথা বলেন তিনি। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগ আমদানির একটি নির্দিষ্ট স্পট তৈরি করেছিল। হঠাৎ করেই এ স্পটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কিছু কিছু খাদ্য পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। এই সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিকল্প পথ খুঁজে বের করে। এখন সেই সমস্যা আর নেই। তবে মূল্যস্ফীতির যে সংখ্যা এখন দেখানো হচ্ছে তা দেখে মনে হবে এই সরকারের তিন মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। বিষয়টি আসলে তেমন নয়। এখানে আসল তথ্য হচ্ছে আগে পরিসংখ্যান জালিয়াতি হয়েছে। প্রকৃত চিত্র মানুষের কাছে আসতে দেওয়া হয়নি। এখন আমরা সেই বাধা দূর করেছি। আর্থিক খাতের প্রকৃত চিত্র সবার কাছে যাচ্ছে। ফলে মনে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বা রপ্তানি কমে গেছে। বরং আমি বলতে চাই বাস্তব চিত্র এখন আপনারা পাচ্ছেন।
মূল্যস্ফীতির বড় আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিগত সরকার টাকা ছাপিয়েছে দেদারসে। এসব অর্থ বাইরে চলে গেছে। ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সেটি নিয়েছেন, কিন্তু দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে সেই টাকা ব্যবহার হয়নি। এতে মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দিয়েছে। তবে আমরা সেই নীতি থেকে বেরিয়ে আসছি। এখন টাকা ছাপিয়ে সাময়িক সমাধান নয়, বরং মনিটরিং পলিসি শক্তভাবে মানা হচ্ছে। প্রশ্ন ছিল এই সরকারও টাকা ছাপিয়েছে, এর কারণ কী ছিল। জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপা হয়েছে কিন্তু সেটি যাবে ট্রেডিং-এর জন্য, কোনো মেগা প্রকল্পের জন্য নয়।
মুদ্রা পাচার নিয়ে আপনার সরকারের ভূমিকা কি? জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, মুদ্রা পাচার রোধে ইতিমধ্যে অসৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বড় একটি অংশের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে মনিটরিং ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে টাস্কফোর্স তাদের কাজ শুরু করেছে। তিনি আশা করেন আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এর সুফল আসবে।
বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও আশাজনক নয় উল্লেখ করে অর্থউপদেষ্টা বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তারা ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের মধ্যেই বিনিয়োগ খাতে ভালো সংবাদ পাওয়া যাবে। বিদেশি বিনিয়োগে এখনও শ্লথগতির কারণ হিসেবে তিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিদেশিদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল। তবে সেটি কাটতে হয়তো আর বেশি সময় লাগবে না।
বৈদেশিক ঋণে এই সরকার অনেক বেশি সাড়া পেয়েছে জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এডিবি’র মতো উন্নয়ন সহযোগীরা ইতিমধ্যে আশ্বস্ত হতে পেরেছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর্থিক খাতে সংস্কারের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে। তাই ইতিমধ্যে তারা আমাদের সব রকম সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সবাই একটি বার্তা পেয়েছে বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্যে এই খাতের উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বিগত পনের বছরে আর্থিক খাতের নাজুক অবস্থার জন্য তাদের তৈরি পরিসংখ্যান জালিয়াতি সবচেয়ে দায়ী বলে মনে করেন প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বিগত সরকারের একটি উদ্দেশ্যই ছিল প্রচারসর্বস্ব উন্নয়ন। তাই তারা ডাটা তৈরি করেছেন মনগড়াভাবে। বিশেষ করে রিজার্ভ, রেমিটেন্স, জিডিপি নিয়ে আংশিক সত্য দিয়ে তথ্য সাজানো হয়েছে। অর্থনৈতিক যেসব গ্রথ দেখানো হয়েছে সেগুলো ছিল তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন না হলেও ব্যক্তি-গোষ্ঠীর উন্নয়ন হয়েছে। ফলে মানুষের আয়ের বৈষম্য চরমে চলে যায়। সম্পদের বৈষম্যের কারণে গরিব আরও গরিব হয়েছে, ব্যক্তি আর কিছু গোষ্ঠী সম্পদের পাহাড় করেছেন। চাকরির ক্ষেত্রে যেমন গোষ্ঠীকে বেছে নেওয়া হয়েছে, ঠিক তেমনি ব্যবসার ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়েছে কিছু ব্যক্তি আর গোষ্ঠী।
ব্যাংক খাতে বড় সংস্কারে হাত দিয়েছে এই সরকার জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক খাত একেবারেই নেই। অনিয়মের জালে বন্দি করে এই খাতকে একেবারে শেষ করে ফেলা হয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক এখন অস্তিত্ব সংকটে। তাদের আমানত ঝুঁকির মধ্যে আছে। সেই ঝুঁকি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। কিছু লোক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। ফলে ছোট ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা এত বছর অর্থই পায়নি। এর প্রভাবে ব্যাংকের টাকা বাইরে গেলেও ব্যবসার উন্নয়নে লাগেনি। ফলে দেশে কর্মসংস্থানও হয়নি।
রাজস্ব আয়ে ট্যাক্স ফাঁকির কথা তুলে ধরে ধরে তিনি বলেন, হাসিনার আমলে রাজস্ব আদায় কাগজে-কলমে দেখানো হতো। কারণ কিছুসংখ্যক ব্যক্তি আর গোষ্ঠীর হাতে গোটা ব্যবসা থাকায় তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে। রাজস্ব আদায় ঠিকমতো হয়নি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রপ্তানি আয় দেশে ঠিকভাবে আসেনি। পণ্য বাইরে গেলেও অর্থ আর আসেনি। আবার আমদানি বেড়ে গেলেও, রপ্তানির গতি ঠিক না থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি বছরের পর বছর বেড়েছে। সেই ঘাটতিও আবার পরিসংখ্যান জালিয়াতির মাধ্যমে আড়ালে পড়েছে। বিশেষ দেশের উপর আমদানি নির্ভরতার কারণে ও সেই বিশেষ দেশের স্বার্থ দেখার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি এখন একটি বড় বোঝা বলে মনে করেন অর্থ উপদেষ্টা।